খোলাফায়ে রাশেদিন ও বর্তমান মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ পদ্ধতির মধ্যকার সামঞ্জস্যতার সংক্ষিপ্ত ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ, প্রথম পর্ব
খোলাফায়ে রাশেদিন ও বর্তমান মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ পদ্ধতির মধ্যকার সামঞ্জস্যতার সংক্ষিপ্ত ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ, প্রথম পর্ব
লিখেছেন: এ এন হাসবি
মুসলিম শাসকের কর্তব্য হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদের জন্য যথাপোযুক্ত ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া। অনুরূপভাবে- আলেম সমাজ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি মজলিসে শুরা বা পরামর্শসভা গঠন করা।সাধারণ মানুষ বা চাটুকারদের এ পরিষদে স্থান দেয়া উচিত নয়। এটা করলে তারা তাদের আত্মীয়স্বজন বা দলীয় লোক বা যে ব্যক্তি বেশি অর্থ প্রদান করবে সেসব লোকদের দায়িত্ব দিবে।খলিফার নীচে যেসব পদ রয়েছে সেসব পদে নিয়োগ দেয়ার অধিকার খলিফার। খলিফা যোগ্য ও আমানতদার ব্যক্তিদের নির্বাচন করবেন এবং তাদেরকে সেসব পদের জন্য নিয়োগ দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যারা আমানত ধারণের যোগ্য তাদেরকে আমানত দিবে। আর যখন মানুষের মাঝে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভাবে ফয়সালা করবে।”এ আয়াতে কারীমাতে শাসকবর্গকে উদ্দিষ্ট করা হয়েছে। আর আমানত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও পদসমূহ। আল্লাহ তাআলা শাসকের কাছে এটাকে আমানত রেখেছেন। যোগ্য ও বিশ্বস্ত লোককে এসব পদের জন্য নির্বাচন করা হলে এ আমানত যথাযথভাবে আদায় হবে। যেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন যারা এসব পদের জন্য যোগ্য ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম তাদেরকে এসব দায়িত্বের জন্য নির্বাচন করতেন। বর্তমান যামানায় পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে এটি ইসলামী পদ্ধতি নয়। এসব নির্বাচন বিশৃঙ্খলা, ব্যক্তিগত পছন্দ, স্বজনপ্রীতি ও লোভ-লালসার কেন্দ্রবিন্দু। এসব নির্বাচনে গণ্ডগোল ও রক্তপাত হয়ে থাকে। এভাবে প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। বরং এসব নির্বাচন চরম অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে।
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফা তিনটি প্রদ্ধতির কোন একটির মাধ্যমে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন।
এক:
আহলে হিল্ল ও আকদ এর পক্ষ থেকে মনোনীত বা নির্বাচিত হয়ে। উদাহরণতঃ আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর সমস্ত সাহাবী তাঁর খিলাফতের পক্ষে ঐক্যমত্য পোষণ করেন, তাঁর হাতে বায়াত করেন এবং তাঁর খিলাফতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
দুই:
ক্ষমতাসীন খলিফা কর্তৃক আমানতদার যোগ্য ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি উত্তরসূরি মনোনীত করা।তথা পূর্ববর্তী খলিফার দেয়া প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অর্থাৎ পূর্ববর্তী খলিফা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে তাঁর পরবর্তী খলিফা হিসেবে প্রতিশ্রুতি দিবেন। এর উদাহরণ হচ্ছে- উমর (রাঃ) এর খিলাফত। তাঁর খিলাফত আবু বকর (রাঃ) এর দেয়া প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছিল।
অনুরূপভাবে উসমান বিন আফফান (রাঃ) এর খিলাফতও এভাবে সাব্যস্ত হয়েছিল। উমর (রাঃ) তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করার জন্য শীর্ষস্থানীয় ছয়জন সাহাবীর সমন্বয়ে একটি পরামর্শসভা গঠন করেছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে আব্দুর রহমান বিন আওফ মুহাজির ও আনসারসহ মদিনা রাষ্ট্রের প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে প্রায় সব সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। যখন দেখলেন যে, লোকেরা উসমান (রাঃ) কে চাচ্ছে তখন তিনিই প্রথম তাঁর হাতে বায়াত করেন। এরপর ছয়জনের অবশিষ্ট সাহাবীগণও তাঁর হাতে বায়াত করেন। এরপর মুহাজির ও আনসারগণ তাঁর হাতে বায়াত করেন। এভাবে আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনুরূপভাবে আলী (রাঃ) এর মনোনয়ন ও নির্বাচনও অধিকাংশ আহলে হিল্ল ও আকদ এর মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।
তিন:
শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। অর্থাৎ কেউ যদি তার অস্ত্র ও ক্ষমতা বলে মুসলিম দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়ে তাকে মেনে নিতে মানুষকে বাধ্য করে এবং স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হন এবং ইসলামি শরীতের ক্ষতিসাধন না করে সেক্ষেত্রে তিনি মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। উদাহরণতঃ কিছু কিছু উমাইয়া খলিফা ও আব্বাসী খলিফা এবং তাদের পরবর্তীতে কিছু কিছু খলিফা এভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এটি শরিয়ত বিরোধী ও চরম বেআইনী পদ্ধতি। কারণ অন্যায়ভাবে, জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। তবে উম্মতের একজন শাসক থাকুক সে মহান কল্যাণের দিক এবং দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মত সাংঘাতিক অকল্যাণের দিক বিবেচনা করে জোরপূর্বক ও অস্ত্রবলে ক্ষমতা গ্রহণকারী আল্লাহর দেয়া শরিয়ত অনুযায়ী শাসন করলে তার আনুগত্য করতে হবে।
ইসলামী গণ-রাষ্ট্রের প্রথম খলীফা ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা)। ইসলামের ইতিহাসে রাসূলে করীম হযরত মুহাম্মাদ(স)-এর পরেই হযরত আবূ বকর (রা)-এর স্থান। ইসলামী ঐতিহ্যের দিক দিয়েও রাসূলের পর তিনিই সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তি। নবী করীম(স) তাঁহার তেইশ বৎসরকালীন সাধনার মাধ্যমে যেখানে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে আরবের কঠিন জাহিলিয়াতের প্রাসাদ চুরমার করে তার ধ্বংসস্তূপের উপর ইসলামের উজ্জ্বল আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন,সেখানে হযরতের ইন্তেকালের অব্যবহিত পরই জাহিলিয়াতের প্রতিবিপ্লবী শক্তির উত্তোলিত মস্তক চূর্ণ করিয়া দিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করিয়াছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)।হযরত আবূ বকর সিদ্দীক(রা) পুরুষদের মধ্য সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মাদ (স)-কে সত্যিকার নবী বলে বিশ্বাস স্থাপন করেন। উনার এই ঈমানই পরবর্তীকালে তাকে ‘সিদ্দীক’ বা ‘সত্য-স্বীকারী’ উপাধিতে ভূষিত হবার গৌরব দিয়েছে। নবুয়্যাতের দীর্ঘ তেইশ বছরে তিনি দ্বীন-ইসলামকে কায়েম করার প্রচেষ্টায় জান-মাল ও ইজ্জত পর্যন্ত কুরবান করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি; বরং এই ক্ষেত্রে তিনি অপরাপর সাহাবী এবং সমস্ত মুসলমানদের অপেক্ষা অধিক অগ্রসর ছিলেন। ইসলাম কবুল করার পর থেকে রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল তিনি হযরতের সাহায্য-সহযোগিতা,দ্বীন-ইসলামের প্রচার ও কাফিরদের অত্যাচার-নিষ্পেষণ হতে মুসলমানদের রক্ষা করার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত-সমস্ত থাকতেন। রাসূলের প্রতিটি নির্দেশকে তিনি নিজের সমস্ত কাজের উপর প্রাধান্য দান করতেন। রাসূলের জন্য তিনি নিজ জীবনেরও কোন পরোয়া করেন নাই। কাফিরদের সাথে প্রতিটি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তিনি রাসূলের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া লড়াই করেছেন। ঈমানের অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ও ইস্পাত-তুল্য অনমনীয়তার পাশাপাশি তার উন্নত চরিত্র বিশ্ব-মুসলিমের জন্য এক অতুলনীয় আদর্শ। এই কারণেই তিনি ছিলেন অতীব জনপ্রিয় ব্যক্তি;তাঁহার প্রতি গোটা বিশ্বের মুসলমানের ভালবাসা ছিল অপূর্ব। হযরত আবূ বকর (রা)- দ্বীনী মর্যাদা এবং তাঁহার প্রতি জনগণের অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণেই, রাসূল করীম(স) যখন রোগশয্যায় শায়িত, তখন খোদ রাসূলই তাকে নামাযে ইমামতী করার জন্য নির্দেশ দান করেন। ইহা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা।কেননা খলিফা তথা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে নামাযের ইমামতিত্ব করা।যেটা রাসূলে কারীম (সঃ) উদাহরণ হিসেবে উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।অতঃপর রাসূলের ইন্তেকালের পর তাকেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম খলীফা নির্বাচিত করা হয়। আনসার ও মুহাজিররাসহ মুসলমানদের সাধারণ পরিষদে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই খলীফা নির্বাচিত হন।
চলবে...

No comments