করোনা কালে, ভ্যাকসিন সমাচার. সমাচার পর্ব ৩...
করোনা কালে, ভ্যাকসিন সমাচার. সমাচার পর্ব ৩...
আগের দুই পর্বে আমরা বিভিন্ন প্রকারের ভ্যাকসিন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করেছি। আগের দুই পর্ব থেকে আমরা যদি ভ্যাকসিনের মোটামুটি একটি সংজ্ঞা দাঁড় করায় তাহলে বলতে পারি, ভ্যাকসিন হচ্ছে এমন একটি রাসায়নিক মিশ্রণ অথবা দ্রবণ যেখানে সংলিষ্ট ভাইরাসের দেহাংশ অথবা সম্পূর্ণ ভাইরাসটি দুর্বল অথবা মৃত অবস্থায় অবস্থিত থাকে, যা মানব শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করার জন্য প্রবেশ করানো হয় , ওই নির্ধারিত রাসায়নিক দ্রবণ অথবা মিশ্রণকে ভ্যাকসিন বলা হয়। আচ্ছা ভ্যাকসিন কার হাত ধরে আবিষ্কার হয়েছিল জানেন কি? তিনি হচ্ছেন এডওয়ার্ড জেনার। আজ থেকে প্রায় দু'শো বছরের বেশি পূর্বে ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাউফক্স এর জীবাণু ব্যবহার করে স্মলপক্স এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন মানব শরীরে। কিভাবে? ঠিক আছে একটু ইতিহাস ঘুরে আসা যাক।
![]() |
| অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে স্মলপক্স ভাইরাস Source: http://commons.wikimedia.org |
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ সালে ইজিপ্ট আর হিট্টিট দের মধ্যকার যুদ্ধে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্মলপক্স নামের ভাইরাসটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে হিট্টিট বন্দীদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ইজিপ্ট জুড়ে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন আরবিও বণিকদের মাধ্যমে ভাইরাসটি ইউরোপ আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় গিয়ে মোটামুটি বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটি মহামারী আকারে মানুষদের আক্রান্ত করতে থাকে। শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীতে ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। আর স্মলপক্স এর ভয়াবহতা কেমন ছিল তা নিচের চিত্রটি দেখলেই বোঝা যায়। এটি আর অন্য কোন দেশের নয়, বাংলাদেশের একটি শিশুর ছবি। আত্মীয়স্বজন এমনকি আপন মা-বাবাও আক্রান্তদের দূরে ঠেলে দিত এই ভাইরাসের ভয়ে।
তবে ভ্যাকসিন আসার পূর্বে এ স্মলপক্স ভাইরাসটি একেবারেই অপ্রতিরোধ্য ছিল বলা যাবেনা। খ্রিস্টপূর্ব ১০২২ সালে "the correct treatment of smallpox" বইয়ের তথ্য অনুসারে, চায়নার সিচুয়ান প্রদেশের "ও মেই শান" নামের এক বিখ্যাত পাহাড়ে বাস করত এক বুদ্ধিস্ট পন্ডিত। তিনি স্মলপক্স দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার শুকনো ক্ষত গুলোকে নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে গুড়া করতেন। এরপর ওইগুলো সুস্থ মানুষের নাকের ভেতরে ফুক দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন ক্ষত চামড়ার গুড়া প্রয়োগে নতুন করে আক্রান্ত যেসব ব্যক্তি স্মলপক্স কে মোকাবেলা করতে পেরেছে তারা দ্বিতীয়বারের মতো আর কখনো এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় Variolation. পরবর্তীতে ১৭০০ সালের দিকে তৎকালীন ডাক্তাররা স্মল পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতে সুই অথবা চুরি স্পর্শ করিয়ে সুস্থ ব্যক্তির হাতে চার থেকে পাঁচটি দাগ কেটে দিতেন। আর এই পদ্ধতিটি ভালই কাজ করতে লাগল। দেখা গেল প্রথমবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আর কখনো ওইসব ব্যক্তি স্মলপক্স দ্বারা দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হননি। কিন্তু তারপরও এই ব্যবস্থাটি পর্যাপ্ত ছিল না। দেখা গেছে আক্রান্ত হওয়া ৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিল।
এরপর ১৭৯৬ সালের দিকে এডওয়ার্ড জেনার আধুনিক ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটান। তিনি একবার গরুর খামারে কাজ করা একটা মহিলার কাছে শুনেছিলেন, মহিলাটি কখনো স্মলপক্স দ্বারা আক্রান্ত হননি কেবলমাত্র একবার তার শুধু কাউফক্স হয়েছিল। কিন্তু মহিলাটি পরে পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল এবং তার শরীরে কাউপক্সের কোন দাগ লক্ষণীয় ছিলনা। প্রসঙ্গত কাউফক্স হলো ভাইরাসজনিত একটি চর্মরোগ। যদিও স্মলপক্স এবং কাউফক্স দুটি একই পরিবারের ভাইরাস হবে কাউফক্স তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক ছিল। মহিলাটির ঘটনাটি চিন্তা করে এডওয়ার্ড জেনার একটি এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মহিলাটির কথাটি সঠিক মহিলাটি কাউফক্স দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর তার শরীরে এমন কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা দ্বারা সে পরবর্তীতে স্মলপক্সের ভাইরাস প্রতিহত করতে পেরেছেন ফলস্বরূপ তার কখনো স্মলপক্স হয়নি। এডওয়ার্ড জেনার তার এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে চিন্তা করলেন কাউফক্সের জীবাণু ব্যবহার করে স্মলপক্স ভাইরাসকে ঠকানো সম্ভব।
![]() |
| স্মলপক্সে আক্রান্ত হওয়া বাংলাদেশি একটি শিশু Source: http://commons.wikimedia.org |
তবে ভ্যাকসিন আসার পূর্বে এ স্মলপক্স ভাইরাসটি একেবারেই অপ্রতিরোধ্য ছিল বলা যাবেনা। খ্রিস্টপূর্ব ১০২২ সালে "the correct treatment of smallpox" বইয়ের তথ্য অনুসারে, চায়নার সিচুয়ান প্রদেশের "ও মেই শান" নামের এক বিখ্যাত পাহাড়ে বাস করত এক বুদ্ধিস্ট পন্ডিত। তিনি স্মলপক্স দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার শুকনো ক্ষত গুলোকে নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে গুড়া করতেন। এরপর ওইগুলো সুস্থ মানুষের নাকের ভেতরে ফুক দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন ক্ষত চামড়ার গুড়া প্রয়োগে নতুন করে আক্রান্ত যেসব ব্যক্তি স্মলপক্স কে মোকাবেলা করতে পেরেছে তারা দ্বিতীয়বারের মতো আর কখনো এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় Variolation. পরবর্তীতে ১৭০০ সালের দিকে তৎকালীন ডাক্তাররা স্মল পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতে সুই অথবা চুরি স্পর্শ করিয়ে সুস্থ ব্যক্তির হাতে চার থেকে পাঁচটি দাগ কেটে দিতেন। আর এই পদ্ধতিটি ভালই কাজ করতে লাগল। দেখা গেল প্রথমবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আর কখনো ওইসব ব্যক্তি স্মলপক্স দ্বারা দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হননি। কিন্তু তারপরও এই ব্যবস্থাটি পর্যাপ্ত ছিল না। দেখা গেছে আক্রান্ত হওয়া ৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিল।
![]() |
| Variolation method |
এরপর ১৭৯৬ সালের দিকে এডওয়ার্ড জেনার আধুনিক ভ্যাক্সিনেশন পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটান। তিনি একবার গরুর খামারে কাজ করা একটা মহিলার কাছে শুনেছিলেন, মহিলাটি কখনো স্মলপক্স দ্বারা আক্রান্ত হননি কেবলমাত্র একবার তার শুধু কাউফক্স হয়েছিল। কিন্তু মহিলাটি পরে পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল এবং তার শরীরে কাউপক্সের কোন দাগ লক্ষণীয় ছিলনা। প্রসঙ্গত কাউফক্স হলো ভাইরাসজনিত একটি চর্মরোগ। যদিও স্মলপক্স এবং কাউফক্স দুটি একই পরিবারের ভাইরাস হবে কাউফক্স তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক ছিল। মহিলাটির ঘটনাটি চিন্তা করে এডওয়ার্ড জেনার একটি এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মহিলাটির কথাটি সঠিক মহিলাটি কাউফক্স দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর তার শরীরে এমন কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা দ্বারা সে পরবর্তীতে স্মলপক্সের ভাইরাস প্রতিহত করতে পেরেছেন ফলস্বরূপ তার কখনো স্মলপক্স হয়নি। এডওয়ার্ড জেনার তার এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে চিন্তা করলেন কাউফক্সের জীবাণু ব্যবহার করে স্মলপক্স ভাইরাসকে ঠকানো সম্ভব।
কাউপক্সে আক্রান্ত Sarah Nelmes নামের এক মহিলার কাছ থেকে তিনি কাউপক্স ভাইরাস সংগ্রহ করেন। এরপর James Phipps নামের আট বছরের এক বাচ্চার শরীরে দাগ কেটে ওই ভাইরাসটি প্রবেশ করান। কিছুদিন জ্বর নিয়ে ছেলেটি পরে কাউফক্স থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে। এর পরবর্তী দুই মাস পর এডওয়ার্ড জেনার স্মল পক্সের জীবাণুর নিয়ে ঐ বাচ্চাটির শরীরে পুনরায় প্রবেশ করান। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন ছেলেটির শরীরে স্মলপক্স এর কোনো প্রভাবই দেখা যাচ্ছে না। তিনি তাঁর হাইপোথিসিসকে আরো শক্তিশালী করার জন্য পরবর্তীতে আরো অনেকগুলো মানুষের শরীরে পূর্বের এক্সপেরিমেন্টের পুনরাবৃত্তি ঘটান। সর্বক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কাউপক্স মানব শরীরে স্মলপক্স এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। উল্লেখ্য যে Variolation পদ্ধতিতে কিন্তু সরাসরি স্মলপক্স ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু এডওয়ার্ড জেনারের Vaccination পদ্ধতিতে স্মলপক্স এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি ভাইরাস কে ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং এটি সাফল্য এনে দিয়েছিল। এরপর ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে Vaccination পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হয় এবং Variolation পদ্ধতি কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এডওয়ার্ড জেনার এর মূল হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করেই বর্তমানের ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতি পরিচালিত হচ্ছে।
![]() |
| শিল্পীর কল্পনায় এডওয়ার্ড জেনার আট বছরের বাচ্চাটিকে ভ্যাকসিন দিচ্ছেন। Source: http://commons.wikimedia.org |
এবার একটু নজর দেওয়া যাক সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত বিষয় যেটি পুরো বিশ্বকে নাকাম করে দিয়েছে। হ্যাঁ সত্যি ধরেছেন, করোনা ভাইরাসের কথাই বলছি। লিখাটি যখন পড়েছেন তখন প্রায় 18 শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় 200 টিরও দেশে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। মানব জাতি আজ উন্নতির উচ্চতম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাহাড় গড়ে দিচ্ছে, পারমাণবিক মারণাস্ত্রের মহাসমুদ্র বানাচ্ছে সেখানে এই অদৃশ্য (রূপক অর্থে ব্যবহৃত) বস্তুটির কিছুই করতে পারছে না। হাস্যকর ঠেকে কথাটা? মোটেও আসলে হাসির কিছুই না। সাধারণ চিন্তায় বিষয়টি যতটা সহজ মনে করছেন বাস্তবতা আসলে তার থেকেও অনেক গুন কঠিন। একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন ডেভলপ করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্বের বাঘা বাঘা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাতদিন খেটে এই ভাইরাসের সমীকরণ মেলাতে পারছে না। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তানিয়া আমরা খুব সহজভাবে সাধারণ ভাষায় আগামী পর্বে আলোচনা করব।
চলবে...





No comments